যেভাবে তথ্য গোপন রেখে অস্ত্রের লাইসেন্স নেন ‘বড়শালার বতুশা’

প্রকাশিত: ৩:০৩ পূর্বাহ্ণ, জুলাই ৬, ২০২০

যেভাবে তথ্য গোপন রেখে অস্ত্রের লাইসেন্স নেন ‘বড়শালার বতুশা’

সুলতান সুমন::

বিতর্ক পিছু ছাড়ছেনা সিলেট সদর উপজেলার বড়শলা গ্রামের ফয়জুল হক বতুশার। এবার তার বিরুদ্ধে অভিযোগ তথ্য গোপন করে আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স নেওয়ার। বর্তমানে তার সেই আগ্নেয়াস্ত্র জব্দ রয়েছে জেলা প্রশাসনের আদেশে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, বতুশা সৌদিআরব ও ইংল্যান্ড একাধিকবার ভ্রমণ করেন। কিন্তু কোন দেশে স্থায়ীভাবে বসবাস করেননি। কোন দেশের স্থায়ী নাগরিকত্ব নেই তার। মূলত বাংলাদেশের নাগরিক তিনি ।

অথচ সিলেট জেলা প্রশাসক কার্যালয় থেকে একটি দুনলা বন্দুক’র লাইসেন্স নিতে গিয়ে সেখানে অপকৌশলের আশ্রয় নেন বতুশা। নিজেকে প্রবাসী হিসাবে আবেদনে উল্লেখ করেন।

নিজের তথ্য গোপন করে সরকারের রাজস্ব ফাঁকি দিতে নানা কৌশলের আশ্রয় নেন। ফলে পেয়েও যান অস্ত্রের লাইসেন্স।

এলাকায় আধিপত্য বিস্তারের জন্য অস্ত্রের লাইসেন্স নিলেও নিজের কব্জায় বেশীদিন সেটি রাখতে পারেন নি। সেই অস্ত্র দেখিয়ে এলাকার লোকজনকে হয়রানি শুরু করেন। একপর্যায়ে এলাকার লোকজন ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। তার অস্ত্রের ব্যবহার নিয়ে এলাকায় কানাঘুষো শুরু হয়।

এলাকার লোকজন জানান, বতুশার সাথে থাকে নিজস্ব সন্ত্রাসী বাহিনীর অবৈধ অস্ত্রের মহড়া। আর এ সকল অস্ত্র দিয়েই ফাঁকা গুলি করে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেন তিনি। এ নিয়ে স্থানীয় বাসিন্দা জাকির আহমদ চৌধুরী বন্দুকের লাইসেন্স বাতিলের আবেদন করেন। তার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তদন্ত শুরু হয়। আর সেই তদন্তেই উঠে আসে বতুশার তথ্য গোপনের ঘটনা।

অভিযোগ তদন্তের পর ফয়জুল হক বতুশার বন্দুক জব্দ করা হয়। সিলেটের জেলা প্রশাসক এম কাজী এমদাদুল ইসলাম তার বন্দুক জব্দ করেন৷

জেলা প্রশাসক কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, ২০১২ সালের ১৪ অক্টোবর সিলেটের বড়শলা’র মৃত ইদ্রিছ খাঁনের ছেলে ফয়জুল হক খাঁন (৫০) নিজস্ব বাসায় রাখার জন্য দুনলা বন্দুকের আবেদন করেন। সেখানে শিক্ষাগত যোগ্যতা অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত উল্লেখ করা হয়। আর ২৬’শ টাকা আয়কর প্রদান করা হয়।

দরখাস্তে আরও উল্লেখ করা হয় তিনি প্রবাসী (দেশে প্রতিষ্ঠিত)। আর যে কোন সময় প্রয়োজনে তিনি প্রবাসে চলে যাবেন। প্রয়োজনে বাংলাদেশে আসেন। ওই আবেদনের প্রেক্ষিতে জেলা প্রশাসক ফয়জুল হক খাঁন’র সার্বিক বিষয়ে তদন্ত প্রতিবেদনের জন্য এয়ারপোর্ট থানায় পত্র প্রেরণ করেন।

একাধিক এলাকাবাসী জানান, বতুশা বন্দুকের লাইসেন্সের জন্য তখনকার তদন্তকারী কর্মকর্তাদের সাথে যোগসাজসে প্রবাসী বলে প্রতিবেদন দাখিল করান।

জাকির আহমদ চৌধুরী গত বছরের ৯ ও ২৩ ডিসেম্বর সিলেট জেলা প্রশাসক বরাবরে আবেদনে উল্লেখ করেন, সিলেট বিমানবন্দর এলাকার বড়শলার মৃত ইদ্রিছ আলীর ছেলে ফয়জুল হক বতুশা দীর্ঘদিন থেকে পেশি শক্তি ও অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে জায়গা দখল ও মসজিদের তহবিল তসররুফসহ নানা ধরণের অনিয়ম, দূর্নীতি করে এলাকায় এক চরম অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে আসছেন। তিনি এলাকায় ভূমি খেকো হিসেবে পরিচিত । তাছাড়া গত বছরের ৭ নভেম্বর বতুশা তার সন্ত্রাসী বাহিনী নিয়ে অস্ত্রসস্ত্রসহ এলাকার লোকজনের উপর হামলা করেন। এতে জাকির চৌধুরী প্রাণে রক্ষা পেলেও তার গাড়ি ভাঙচুর করা হয়। পরবর্তীতে ওই এলাকার কাউন্সিলর অফিসের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে দ্রুত বিচার আইনে ৭ জনের বিরুদ্ধে পুলিশ চার্জশিট দাখিল করে।

অথচ সেই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে বতুশার গাড়ি ব্যতীত আরও একটি কার এবং দুইটি মোটর সাইকেলসহ ৬ জন জড়িত ছিলেন। ওই মামলায় বতুশা উচ্চ আদালত থেকে জামিন নেন। আদালত থেকে জামিন নেওয়ার পরপরই জাকির চৌধুরী ও তার পরিবারের লোকদেরকে খুন গুমসহ নানা ধরনের হুমকি দেন।

এতে এলাকায় ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। আতঙ্কিত হয়ে পড়েন এলাকার লোকজন। গুম করার হুমকি প্রদান সহ এলাকায় আতঙ্ক সৃষ্টি করেন।

পরবর্তীতে এলাকার শান্তি শৃঙ্বখলা বজায় রাখার স্বার্থে বন্দুকের লাইসেন্স বাতিল ও সেটি জব্দ করার জন্য জেলা প্রশাসক বরাবর আবেদন করেন জাকির চৌধুরী। যার স্মারক নং ৫৮ তাং ২৩/১২/১৯ ইং । আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে অভিযোগ তদন্তের জন্য এ বছরের ১৪ জানুয়ারি এসএমপি কমিশনার বরাবরে পত্র প্রেরণ করেন সিলেটের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মো. আবুল কালাম। সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনারের কার্যালয় থেকে উপ-পুলিশ কমিশনার (উত্তর) এর মাধ্যমে বিমানবন্দর থানার সহকারী পুলিশ কমিশনার প্রবাস কুমার সিংহের কাছে তদন্তের জন্য প্রেরণ করা হয়।

পরে তিনি দীর্ঘদিন তদন্ত করে তদন্তকারী কর্মকর্তা ৫৪ পাতার তদন্ত প্রতিবেদনের শেষে মন্তব্য করেন, নিরাপত্তার স্বার্থে ফয়জুল হক খাঁন বতুশার লাইসেন্সকৃত অস্ত্রটি এয়ারপোর্ট থানা এসএমপি, সিলেট জমা রাখা যেতে পারে।

গত ২৩ এপ্রিল বিমানবন্দর থানার সহকারী পুলিশ কমিশনার প্রবাস কুমার সিংহের তদন্ত প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সিলেটের জেলা প্রশাসক এম কাজী এমদাদুল ইসলাম গত ৪ মে বতুশার আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স নং-৮৩২/১৬৮৭ ও দোনালা বন্দুক নম্বর ১৯৫২২ জব্দ করেন।

এ ব্যাপারে জাকির আহমদ চৌধুরী সিলেট সানকে জানান, তিনি যখন বন্দুকের লাইসেন্স বাতিলের আবেদন করেন। তখন জেলা প্রশাসক তদন্ত প্রতিবেদন চাইলে, তদন্তকারী কর্মকর্তা তার সাক্ষীদের সাক্ষ্য নেননি।

তিনি জানান, গত ২৩ ফেব্রুয়ারি তার মালিকানাধীন ডায়াগনস্টিক থেকে রাতে বাসায় ফেরার পথে বতুশা তার গাড়ির গতিরোধ করেন। একপর্যায়ে বতুশার বাড়ির পিছনের গেটে নিয়ে যাওয়া হয় জাকিরকে। জোর করে জাকিরকে তার বাসায় নিয়ে যান বতুশা । অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেন এবং সাদা কাগজে স্বাক্ষর নেন এবং মামলা তুলে না নিলে প্রাণে মারার হুমকি দেওয়া হয় । এই ঘটনার সাক্ষীদের সাক্ষ্য না নিয়ে উল্টো বতুশার কেয়ারটেকার, দোকানের কর্মচারী, ভাড়াটিয়া ও তার বাহিনীর লোকদের সাক্ষ্য দিয়ে প্রতিবেদন দাখিল করা হয়। অথচ এলাকার স্থানীয় বাসিন্দারা বতুশার বিরুদ্ধে এবং বন্দুকের লাইসেন্স বাতিলের পক্ষে তদন্তকারী কর্মকর্তার কাছে লিখিত বক্তব্য প্রদান করেন।

তদন্তকারী কর্মকর্তা এলাকার লোকদের
সাক্ষ্য না নিয়ে বতুশার পক্ষের লোকদের সাক্ষ্য নেন তদন্তকারী কর্মকর্তা। পরবর্তীতে সে অনুযায়ী জেলা প্রশাসক বরাবরে প্রতিবেদন প্রেরণ করেন।

জাকির চৌধুরী দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, যে কোন ধরনের আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স দিতে বা বাতিল করতে পুলিশের তদন্ত প্রতিবেদনের প্রয়োজন হয়।

কিন্তু কিছু অসাধু পুলিশ কর্মকর্তার যোগসাজশে বার বার এসকল প্রতিবেদনে অসত্য তথ্য উঠে আসে। আর ভুক্তভোগী হতে হয় সমাজের নিরীহ আইনমান্যকারী লোকজনকে।

এ ব্যাপারে ফয়জুল হক খাঁন বতুশা জানান, তিনি ল্যান্ড প্রোপার্টির ও নিজস্ব দোকানপাট ভাড়া ব্যবসা করেন। তিনি এখন দেশেই থাকেন। বর্তমানে তার লাইসেন্সকৃত অস্ত্রটি এসএমপি’র বিমান বন্দর থানায় জমা রাখা হয়েছে ।

সিলেটের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মো. আসলাম উদ্দিন জানান, অস্ত্রের লাইসেন্স নিয়ে যদি কোন ব্যক্তি সেই অস্ত্রের অপব্যবহার করেন। তাহলে সেই অস্ত্রের লাইসেন্স বাতিল করা হবে। তাছাড়া কেউ যদি তথ্য গোপন করে অস্ত্রের লাইসেন্স নেন। সরকারের রাজস্ব ফাঁকি দেন। আর তদন্তে তা প্রমাণিত হয়। তাহলে ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় পত্র প্রেরণ করা হবে।

 

তথ্য সূত্র ‘সিলেট সান ডটকম’ লিংক সংযুক্ত

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ