সাম্প্রতিক সংবাদ

বহুরূপী রহস্যের এক নাম আরিফুল হক চৌধুরী !

প্রকাশিত: ২:৪৬ পূর্বাহ্ণ, নভেম্বর ২৯, ২০১৯

বহুরূপী রহস্যের এক নাম আরিফুল হক চৌধুরী !

আহমদ মারুফ :::::
আরিফুল হক চৌধুরী। সকালে এক রূপ, বিকালে অন্য রূপ। ডিজিটাল সময়ের মতো বদলে যাওয়া বহুরূপী রহস্যের এক নাম। জোট সরকারের আমলে ছিলেন দোর্দান্ত প্রতাপশালী। ক্ষমতার অপব্যবহার ও তার দাপটে সিলেট নগরীর বাসিন্দারা থাকতো আতঙ্কিত। সাবেক অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমানের নাম ভাঙ্গিয়ে স্ব-শিক্ষিত আরিফুল হক চৌধুরী দুর্নীতি-লুটপাট, প্রতারণা ও দখল করে শত শত কোটি টাকা ও সম্পদের পাহাড় গড়েন। এখন সিলেটের শীর্ষ ধনকুবের। নগরপিতা।
দুর্নীতি-লুটপাটের কারণে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে গ্রেপ্তার হয়ে যান জেলহাজতে। উচ্চ আদালতের নির্দেশে তিনি ছাড়া পেলেও তার মামলাগুলো এখনও চলমান রয়েছে।
স্থানীয় সব নেতাদের টেক্কা মেরে কিভাবে প্রভাবশালী অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমানের এতো কাছের মানুষ হয়ে গেলেন তা নিয়ে দলীয় নেতাদের মাঝে আছে কানাঘোষা। সাইফুর রহমান আরিফকে ছাড়া কাউকে বিশ্বাস করতেন না। এখানেই বিস্ময়ের কারণ। আরিফের মাধ্যমে না গেলে তিনি কারও সঙ্গে দেখাও করতেন না। এ কারণেই নগরীর বাসিন্দারা আরিফকে সাইফুর রহমানের ‘ছায়া মন্ত্রী’ও মনে করতেন। এই সুযোগটিই কাজে লাগান আরিফ। সাইফুর রহমান সিলেটে আসলে সারাক্ষণ তার পাশে থাকতেন। তার পাশে ছবি তুলেই একজন কাউন্সিলর থেকে আরিফ বড় নেতা হয়ে উঠেন।
কূটকৌশলী আরিফুল হক চৌধুরী। মেয়র নির্বাচিত হয়ে খোলস পাল্টে ফেলেন। সৎ যোগ্য নেতা হিসেবে নাগরিকদের সুনাম অর্জন করতে মরিয়া হয়ে উঠেন। কিন্তু বাস্তবে যেই লাউ সেই কদুই দৃশ্যমান। জোট সরকারের আমলের সেই আসল চেহারা আস্তে আস্তে উন্মোচিত করেন-আরিফ। দুর্নীতি প্রতারণার কূটকৌশলের ম্যাজিক প্রয়োগে করতে গিয়ে ধরা খাচ্ছেন বার বার।
নাগরিক সেবার লেভেলে আরিফ শুরু করেন ফুটপাত থেকে হকার উচ্ছেদ। অভিযানে হকারদের ফুটপাত থেকে সকালে উচ্ছেদ করা হয়। কিন্তু বিকালে হকাররা ফের ফুটপাত দখল করে বসে। ফুটপাত উচ্ছেদ নাটক চলে প্রায় দু’মাস থেকে।
বৃহস্পতিবার আকষ্মিক ‘হই হই, রই, রই’-মেয়র আরিফ গেলো কই’-এমন শ্লোগানে প্রকম্পিত হয়ে উঠে জিন্দাবাজার থেকে চৌহাট্টা রোড।
বুধবার সন্ধ্যার পর নিজের গাড়িতে করে জিন্দাবাজার থেকে চৌহাট্টার দিকে যাচ্ছিলেন মেয়র আরিফ। জিন্দাবাজার আল হামরা শপিং সিটির সামনে আসা মাত্র হুট করে গাড়ি থেকে নেমে পড়েন মেয়র। এসময় ফুটপাতে পোশাকসহ বিভিন্ন পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেছিলেন হকাররা। গাড়ি থেকে নেমেই মেয়র ফুটপাতে রাখা এসব কাপড় টেনে নিয়ে যেতে শুরু করেন। এ সময় হকারকে মারধরও করেন মেয়র। হকার মারধরের ঘটনায় এমন অবরোধ কর্মসূচি পালন করছে হকাররা। অবরোধকারী হকাররা জানান, মেয়র আরিফুল হক ফুটপাত অভিযানের নামে দীর্ঘদিন থেকে নাটক মঞ্চস্থ করে যাচ্ছেন। এই নাটকের মূল লক্ষ্য যুবদল ও বিএনপি সমর্থিত হকারদের নগরীতে পুনর্বাসিত করা।
শহীদ মিনারের সামনের ফুটপাতে কাপড় বিক্রেতা আনহার মিয়া জানান, আমরা গরীব মানুষ। তাই এখানে বসি। সন্ধ্যা পর আমি আমার ছেলেকে এখানে বসিয়ে একটু বাইরে গিয়েছিলাম। কিছুক্ষণ পরে এসে দেখি মেয়র শার্ট নিয়ে যাচ্ছেন। এসময় আমি এসে শার্টগুলো ফুটপাত থেকে সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলে তিনি ছেলের সামনেই আমাকে লাথি দেন।
এর আগে ১ কোটি ৫৮ লাখ টাকা দুর্নীতির অভিযোগে প্রদীপ্ত সিলেটবাসীর ব্যনারে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সামনে মানববন্ধন করেন এমপি ডটকমের ফাউন্ডার চেয়ারম্যান সুশান্ত দাস গুপ্ত।
মানববন্ধনে দুর্নীতির শিকার দাবি করে ব্যবসায়ী সঞ্জয় রায় বলেন, ‘২০১৪ সালে সিলেট সিটি কর্পোরেশনে নগর ভবন নির্মাণের জন্য একটি ওয়ার্ক অর্ডার হয়। এ ওয়ার্ক অর্ডারটি ষোলো কোটি আট লাখ টাকা মূল্যে মাহবুব ব্রাদার্স প্রাইভেট লিমিটেডকে প্রদান করা হয়। মাহবুব ব্রাদার্স কাজটি সম্পাদনের জন্য ২০১৪ সালের ২৩ নভেম্বর সম্পাত এন্টারপ্রাইজের প্রোপাইটর আমি সঞ্জয় রায় এর সঙ্গে চুক্তি করে। কাজ শুরুর পর নগর ভবন থেকে মাহবুব ব্রাদার্স প্রাইভেট লিমিটেডের নামে বিল ইস্যু করা হতো এবং মাহবুব ব্রাদার্স অফিস থেকে তিনি নিয়মিত চেক গ্রহণ করে আমার মনোনিত একাউন্টে লেনদেন করতেন। মোট কাজের আনুমানিক ৫ শতাংশ কাজ বাকি থাকাবস্থায় সঞ্জয় রায়ের লিভার সিরোসিস রোগ ধরা পড়ে। এ সময় তিনি ভারতে চিকিৎসা নিতে চলে যান। সে সময় মেয়র আরিফ মূল ঠিকাদার মাহাবুব ব্রাদার্সকে জিম্মি করে দুই কোটি ছেষট্টি লাখ টাকার চূড়ান্ত বিল আমার অগোচরে রেখে আত্মসাৎ করেন।’
সঞ্জয় রায় বলেন, ‘এক পর্যায়ে ২ বছর অতিবাহিত হওয়ার পর কাজের বিপরীতে সিটি কর্পোরেশনে রক্ষিত জামানতের এক কোটি আটান্ন লাখ টাকা মেয়র আরিফ মাহবুব ব্রাদার্সকে ভয়ভীতি দেখিয়ে তার সহযোগী হোটেল ক্যাপিটালের পরিচালক তোফায়েল খানের ব্যাংক একাউন্টে নিয়ে আসেন। ওই সময় মেয়র আরিফ মাহবুব ব্রাদার্সকে এই বলে আশ্বস্ত করেন যে, এই জামানতের টাকা মেয়র নিজের তত্ত্বাবধানে আমাকে প্রদান করবে।’
সঞ্জয় রায় আরো বলেন, ‘জামানতের এই টাকার চেক তোফায়েল খানের একাউন্টে আনার সময় ১৫ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ছয়ফুল আমীন বাকের সাক্ষী হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। কিছু দিন পর আমি জানতে পারি চূড়ান্ত বিলের ন্যায় আমার জামানতের টাকাও আত্মসাৎ করা হয়েছে। তখন আমি মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীর কাছে গিয়ে আমার টাকা দাবি করলে মেয়র আরিফ আমাকে প্রাণে মেরে ফেলার ভয় দেখান। শুধু তাই নয়, আমাকে তার বাসায় আটকে রেখে আমার বাসা থেকে একটি ব্যাংক চেক আনিয়ে জোরপূর্বক স্বাক্ষর করান।’
অনুসন্ধানে আরিফের দুর্নীতির যে চিত্র পাওয়া গেছে তা শুনলে যে কারও গাঁ শিউরে উঠবে। সিলেট নগরী থেকে ৩/৪ কিলোমিটার দূরে খাদিমনগরের শ্যামলনগর টিলার ওপর ২ হাজার ৬৮ শতাংশ (৬২.৬৬ বিঘা) দেবোত্তর সম্পত্তি দখল করে গড়ে তুলেছেন বিশাল বাগান বাড়ি। আঙ্গাউলা মৌজার (জেল নম্বর ৫২) আটটি দাগে (২৭৩৪, ২৭৬১, ২৭৬৩, ২৭৬৪, ২৭৭৯, ২৭৭৮, ২৭৭৭ এবং ২৭৭৬) ছিলো শ্রী শ্রী রাধাকৃষ্ণ স্টার টি এস্টেট (সাং-তারাপুর চা বাগান)। ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর পরই তিনি চা বাগানটি দখল করে নেন। সিলেট ভূমি অফিস সূত্রে জানা গেছে, ভূমি অফিসের রেকর্ডপত্রে বাগান বাড়িটি দেবোত্তর সম্পত্তি বলে উল্লেখ রয়েছে। দেবোত্তর সম্পত্তি বিক্রির কোনো বিধান নেই বলেও জানায় ভূমি অফিস। বাগান বাড়িটি তিনি জাল দলিল করে নিজের নামে লিখে নিয়েছেন।
সার্কিট হাউজ সূত্রে জাগা গেছে, আসাম প্যাটার্নে সিআইসিসিট বাংলো টাইপ কটেজের সম্পূর্ণ মালামাল বিক্রির জন্য ২০০৬ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি টেন্ডার দেয় জেলা প্রশাসন। কুমারপাড়ার জুয়েল আহমেদ ভ্যাট-আয়করসহ ৬ লাখ ৩৪ হাজার টাকায় মালামালগুলো কিনে নেন। সেই মালামাল আরিফ তার বাগান বাড়িতে নিয়ে যান। সার্কিট হাউজের সেই মালামাল আরিফের বাগান বাড়িতে কীভাবে গেল তা জানার পর জেলা প্রশাসনও বিস্মিত হয়ে যায়।
নগরীর অনেক গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান জমি জোরপূর্বক দখলের অভিযোগও রয়েছে আরিফুল হকের বিরুদ্ধে। ২০০৫ সালের এপ্রিল মাসে তিনি সিলেট সদর হাসপাতালের স্টাফ কোয়ার্টার বুলডোজার দিয়ে ভেঙে গুড়ি দিয়ে দখল করে নেন সেখানকার ৫০ শতক জমি।
২০০৬ সালের ১৯ জানুয়ারি ধোপাদীঘির পাড়ের একটি গণশৌচাগার ভেঙে ৫ কাঠা জমি তিনি দখল করে নেন। দখল পাকাপোক্ত করতে সাইনবোর্ড লাগিয়ে সেখানে বসান টেম্পো স্ট্যান্ড। ২০০৫ সালে হযরত শাহ পরাণ (রহ.)-এর মাজারের পাশে গোলাম রাব্বানী নামে এক ব্যক্তির ২১ শতক জমি দখল করে নেন। জমি উদ্ধার করতে গোলাম রাব্বানী মামলা করেন। মামলার বিবরণে তিনি উল্লেখ করেন আরিফ ও তার স্ত্রী শ্যামা হক চৌধুরীসহ কয়েকজনের নামে ভূয়া দলিল তৈরি করে তিনি জমিটি লিখে নিয়েছেন।
চৌহাটা-রিকাবী বাজার-শেখঘাট-সার্কিট হাউজ সড়ক সংস্কারের জন্য ২০০৪ সালের শেষের দিকে দরপত্র ডাকা হয়। সাড়ে ৩ কিলোমিটার রাস্তাটি সংস্কারের জন্য বরাদ্দ ছিলো ২৭ লাখ টাকা। তিনি এই কাজটি দেন তার ঘনিষ্ট দিলার আহমেদকে। পুনরায় দরপত্র ছাড়াই আরিফ তার প্রভাব খাটিয়ে কাজটি ৫ কোটি টাকায় অনুমোদন করিয়ে নেন।
জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর আরিফ জালালাবাদ গ্যাসের পেছনে ৪০ শতাংশ জমি কিনেন। এই জমির প্রতি শতাংশের দাম এখন ৩০ থেকে ৪০ লাখ টাকা। ২০০৬ সালে সোবহানিঘাটে সড়ক ও জনপথের জমি প্রভাব খাটিয়ে লিজ নিয়ে তিনি সুরমা সিএনজি স্টেশন দিয়েছেন। কুমারপাড়ায় ১৫ শতাংশ জমি কিনে সিগনেচার নামে মার্কেট বানান। পরে সেটি ১ কোটি ৩৫ লাখ টাকায় বিক্রি করে দেন।
নগরীর মেন্দিবাগে গার্ডেন টাওয়ারের মালিক হোটেল নির্মাণের জন্য নকশার অনুমোদন নিয়ে সেখানে ফ্ল্যাট বানিয়ে ছিলেন। বিষয়টি জানতে পেরে আরিফ তাকে বিপদে ফেলে বিনামূল্যে মেয়ের নামে একটি ফ্ল্যাট লিখে নেন। একই ভাবে প্রতারণা করে তিনি গ্রামীণ জনকল্যাণ ভবনের ছাদ নিজের নামে লিখে নেন। পরে ভবনের মালিক জামিল চৌধুরীর কাছ থেকে টাকা আদায় করে ছাদ তাকে আবার ফিরিয়ে দেন।
জোট সরকারের আমলে ক্ষমতার জোরে ৪৪টি সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রধান হন আরিফ। তখন নগরীর প্রতিটি অনুষ্ঠানেই তিনি যোগ দিতেন প্রধান অতিথি হিসেবে। কোন কোন অনুষ্ঠানে তিনি সাইফুর রহমানকেও নিয়ে আসতেন।

জোট সরকারের আমলে সিলেটে যত উন্নয়ন হয়েছে, সব খান থেকেই তাকে ১০ পার্সেন্ট কমিশন দেওয়া ছিলো বাধ্যতামূলক। তাকে কমিশন না দিলে ঠিকাদাররা কোনো বিল পেতেন না। তাই সিলেট নগরীতে তিনি মিস্টার ‘টেন পার্সেন্ট’ বলে পরিচিতি পান।

তথ্য সূত্র : দৈনিক সিলেটের দিনকাল, লিংক সংযুক্ত

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ